কোনো চুম্বক শলাকা বা দণ্ড চুম্বককে অনুভূমিকভাবে এর ভারকেন্দ্রে মুক্ত অবস্থায় স্থাপন করলে এটি সব সময়ই মোটামুটি উত্তর-দক্ষিণ দিক বরাবর অবস্থান করে। এ থেকে বোঝা যায় যে, ভূপৃষ্ঠে একটি চৌম্বকক্ষেত্র বিদ্যমান । 1600 খ্রিস্টাব্দে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. গিলবার্ট বিভিন্ন পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেন যে, পৃথিবী একটি চুম্বকের ন্যায় আচরণ করে।
চিত্র ৪.১৯ হতে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা করা যেতে পারে। একটি চুম্বক শলাকাকে বা একটি দণ্ড চুম্বককে কোনো চৌম্বকক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মুক্তভাবে স্থাপন করলে তার অক্ষ ঐ চৌম্বকক্ষেত্র বরাবর স্থাপিত হয়। কোনো চুম্বক শলাকাকে তার ভারকেন্দ্রে যদি সম্পূর্ণ মুক্ত অবস্থায় এমনভাবে স্থাপন করা হয় যে এটি উল্লম্ব তল বরাবর মুক্তভাবে ঘুরতে পারে এবং এই চুম্বক শলাকাকে যদি পৃথিবীর এক মেরু থেকে অন্য মেরুর দিকে সরিয়ে নেয়া হয় তবে দেখা যায় যে চুম্বক শলাকার অক্ষ এবং অনুভূমিকের অন্তর্ভুক্ত কোণ ভূ- পৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন হয়। এ থেকে বোঝা যায় যে, ভূ-পৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে লব্ধি চৌম্বকক্ষেত্রের দিক বিভিন্ন । ঐ কোণকেই বিনতি কোণ বলা হয়। বিষুব রেখার নিকট এর মান শূন্য এবং ভূ-পৃষ্ঠের দুটি স্থানে এর মান 90° হয়। একটি স্থান উত্তর কানাডার হাডসন বে এলাকায় এবং অপর স্থানটি অ্যান্টার্কটিকার নিকটে । ভূ-পৃষ্ঠের এই দুই বিন্দুকে তাই পৃথিবীর চৌম্বক মেরু বলা হয়। এগুলো ভৌগোলিক মেরু নয়। পৃথিবীর চৌম্বক মেরু দুটির সংযোজক সরলরেখা এবং ভৌগোলিক মেরু দুটির সংযোজক সরলরেখার অন্তর্গত কোণ অর্থাৎ পৃথিবীর চৌম্বক অক্ষ এবং ভৌগোলিক অক্ষের অন্তর্গত কোণ প্রায় 11.5°। পৃথিবীর চৌম্বক দক্ষিণ মেরু ভৌগোলিক উত্তর মেরু থেকে প্রায় 1750 km পশ্চিমে এবং চৌম্বক উত্তর মেরু ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরুর পূর্বে অবস্থিত ।
পৃথিবীর কোনো স্থানে ভৌগোলিক উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বরাবর কল্পিত উল্লম্বতলকে ঐ স্থানের ভৌগোলিক মধ্যতল বলে [চিত্র ৪.২০ ]।
মুক্তভাবে সাম্যাবস্থায় অবস্থিত কোনো চুম্বক ঠিক ভৌগোলিক উত্তর-দক্ষিণ বরাবর থাকে না। তাই ভৌগোলিক মধ্যতল ও চৌম্বক মধ্যতল এক নয়। ভৌগোলিক মধ্যতল ও চৌম্বক মধ্যতলের মধ্যে কিছু কৌণিক ব্যবধান থাকে। ঢাকায় এই ব্যবধান 0.5° ।
কোনো স্থানে ভৌগোলিক মধ্যতল ও চৌম্বক মধ্যতলের অন্তর্ভুক্ত কোণকে ঐ স্থানের বিচ্যুতি বলে।
কোনো স্থানে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রকে সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করার জন্য সাধারণত নিম্নোক্ত রাশি তিনটি নির্ণয় করা হয়।
(ক) বিচ্যুতি, θ (খ) বিনতি,
(গ) ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রের অনুভূমিক উপাংশ, BH বা, H
এ তিনটি রাশি পছন্দ করার কারণ হচ্ছে সাহায্যে নির্ণয় করা যায়। এগুলোকে কোনো স্থানের ভূ-চুম্বকের মৌলিক উপাদান বলা হয়।
উল্লম্ব অক্ষের চারদিকে মুক্তভাবে অনুভূমিক তলে ঘূর্ণনক্ষম কোনো চুম্বক শলাকা পৃথিবীর সব স্থানে সম্পূর্ণ ভৌগোলিক উত্তর-দক্ষিণ বরাবর থাকে না-কোনো স্থানে চুম্বক শলাকা ভৌগোলিক উত্তর-দক্ষিণ থেকে যে কোণে বিচ্যুত হয় তাই ঐ স্থানের বিচ্যুতি ।
কোনো স্থানের বিচ্যুতিকে সাধারণত θ দ্বারা প্রকাশ করা হয় (চিত্র ৪.২১)। ঐ স্থানে যদি চৌম্বক মধ্যতল ভৌগোলিক মধ্যতলের পূর্ব পাশে থাকে তবে বিচ্যুতিকে θ° পূর্ব বা θ°E এবং যদি পশ্চিম পাশে থাকে তবে θ° পশ্চিম বা θ°W বলা হয় ।
অর্থাৎ মুক্তভাবে স্থাপিত চুম্বক শলাকার উত্তর মেরু যদি ভৌগোলিক মধ্যতলের পূর্ব পাশে থাকে তবে ঐ স্থানের বিচ্যুতিকে θ° পূর্ব আর পশ্চিম পাশে থাকলে θ° পশ্চিম বলা হয়।
ঢাকার বিচ্যুতি পূর্ব বলতে বোঝায় ঢাকায় মুক্তভাবে স্থাপিত চুম্বক শলাকা ভৌগোলিক উত্তর দক্ষিণের সাথে কোণ করে অবস্থান করে এবং চুম্বক শলাকার উত্তর মেরু ভৌগোলিক পূর্ব পাশে অবস্থান করে ।
কোনো চুম্বক শলাকাকে এর ভারকেন্দ্রের মধ্য দিয়ে অনুভূমিক অক্ষের চারদিকে উল্লম্বতলে ঘুরতে দিলে এটি ভূ- পৃষ্ঠের সব স্থানে ভূমির সমান্তরালে অবস্থান করে না বরং ভূ-চুম্বকের সৃষ্ট চৌম্বকক্ষেত্রের অভিমুখ বরাবর অবস্থান করে । চৌম্বক মধ্যতলে স্থাপিত চুম্বক শলাকা অনুভূমিক তল থেকে যে কোণে নত বা কাত হয়ে থাকে তাকে ঐ স্থানের বিনতি বলে।
অনুভূমিক অক্ষের চারদিকে উল্লম্ব তলে ঘূর্ণনক্ষম কোনো চুম্বক শলাকাকে কোনো স্থানে চৌম্বক মধ্যতলে এনে স্থাপন করলে এর চৌম্বক অক্ষ অনুভূমিক বরাবর না থেকে অনুভূমিকের সাথে কোণ উৎপন্ন করে। এই কোণই বিনতি । বিনতিকে দ্বারা প্রকাশ করা হয় (চিত্র ৪.২২)। কোনো স্থানের বিনতিকে ° উত্তর বা ° দক্ষিণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ° উত্তর বলতে বোঝায় ঐ স্থান পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত এবং চৌম্বক মধ্যতলে স্থাপিত চুম্বক শলাকার উত্তর মেরু ° কোণে অনুভূমিক থেকে নত থাকে। অপরদিকে ° দক্ষিণ বলতে বোঝায় ঐ স্থান পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত এবং চৌম্বক মধ্যতলে স্থাপিত চুম্বক শলাকার দক্ষিণ মেরু ° কোণে নত থাকে ।
ঢাকার বিনতি 31°N বলতে বোঝায় ঢাকায় ভূ-চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্র অনুভূমিক তলের সাথে 31° কোণ উৎপন্ন করে অর্থাৎ মুক্তভাবে চৌম্বক মধ্যতলে স্থাপিত চুম্বক শলাকার উত্তর মেরু 31° কোণে অনুভূমিক তল থেকে নত থাকে।
পৃথিবীর সব স্থানে ভূ-চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্র অনুভূমিকে বরাবর ক্রিয়া করে না। অনেক স্থানে অনুভূমিকের সাথে কোণ করে ক্রিয়া করে। এই লব্ধি চৌম্বকক্ষেত্র যদি চৌম্বক মধ্যতল বরাবর অনুভূমিক ও উল্লম্ব এই দুটি উপাংশে ভাগ করা যায় তবে অনুভূমিক বরাবর যে উপাংশ পাওয়া যায় তাই চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্রের অনুভূমিক উপাংশ।
ধরা যাক, কোনো স্থানের ভূ-চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্র । এই ক্ষেত্র CE বরাবর ক্রিয়া-করে [চিত্র 4.22]। ঐ স্থানে চৌম্বক মধ্যতল বরাবর অনুভূমিক তল CD-এর সাথে মোট চৌম্বকক্ষেত্র । যদি কোণ
উৎপন্ন করে অর্থাৎ ঐ স্থানের বিনতি হলে, ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রের অনুভূমিক উপাংশ H হবে,
H = B cos .,..(4.24)
এবং ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রের উল্লম্ব উপাংশ V হবে
V = B sin ... (4.25)
ঢাকায় ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রের অনুভূমিক উপাংশ 34 x 10-6T বলতে বোঝায় ঢাকায় যে ভূ-চৌম্বকক্ষেত্র ক্রিয়া করে চৌম্বক মধ্যতলে অনুভূমিক বরাবর তার উপাংশের মান 34 x 10-6T |
সমীকরণ (4.24) ও (4.25) থেকে,
.. (4.26)
সমীকরণ (4.26 ) থেকে,
উল্লম্ব উপাংশ, V = H tan ... (4.27)
এবং অনুভূমিক উপাংশ, H= V cot .. (4.28)
আবার, সমীকরণ (4.24) ও (4.25) থেকে,
ভূ-চুম্বকের মোট চৌম্বকক্ষেত্র, .. (4.29)
আরও দেখুন...